সারমর্ম
একটি পোষ্ট চারিদিকে প্রচারিত হচ্ছে যেখানে দাবী করা হয়েছে ডিমের খোলার গুঁড়ো, বেকিং সোডা, নিম পাতার গুঁড়ো, দারুচিনির গুঁড়ো, লবঙ্গ গুঁড়ো এবং নারকোল তেলের মিশ্রণ একটি ভেষজ উপায় যা দিয়ে দাঁতের মধ্যে তৈরী হওয়া গর্ত সেরে যায়। কিন্তু আমরা এর ফ্যাক্ট চেক করে দেখেছি এই দাবী অনেকাংশে ভুল।
দাবি
বাড়িতেই ভেষজ পাউডার বানিয়ে দাঁত মাজলে ক্যাভিটি ও ব্যথা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন – এই দাবি নিয়ে একটি পোস্ট এখানে দেখা যাবে । সোশ্যাল মিডিয়াতে এই ধরণের ভ্রান্তিকর পোস্ট আরো অনেক ছড়িয়ে আছে । প্রতিটি পোস্টে বিভিন্ন আলাদা আলাদা ভেষজ উপাদান ব্যবহারের কথা বললেও মূল দাবিটি এক – দন্ত চিকিৎসককে ছাড়াই দাঁতের ক্ষয় ঠিক করা যাবে ।
সত্যানুন্ধান
দাঁতের গর্ত কী এবং এটা কীভাবে হয়?
যখন মুখের মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া অ্যাসিড তৈরী করে দাঁতের এনামেলকে ক্ষয় বা ডিমানারেলাইজড করে দেয় তখন দাঁতের গর্ত তৈরী হয়, যাকে কেরিস বা দাঁতের ক্ষয় বলে। এখান থেকে ছোট গর্ত বা গহ্বর তৈরী হয়। সাধারণত প্রায়শই মিষ্টি জিনিস বা স্টার্চ জাতীয় খাবার থেকে বা মুখের ভেতরের স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে এইধরনের অ্যাসিডের ক্ষয় হয়। এর প্রথম লক্ষণ হল দাঁতে সাদা দাগ তৈরী হওয়া, এতেই বোঝা যায় এনামেল থেকে মিনারেল ক্ষয়ে যাচ্ছে। সৌভাগ্যবশত, এই পর্যায় মুখের লালারসের মধ্যে থাকা মিনারেল, টুথপেষ্টের ফ্লোরাইড বা দাঁতের বিশেষজ্ঞের সাহায্যে এনামেল নিজে থেকে পরিস্থিতি ঠিক করে নিতে পারে।
কিন্তু, যদি এই ক্ষয় চলতেই থাকে, এতে অনেক পরিমাণ মিনারেল নষ্ট হয়ে যায়, এতে এনামেল দূর্বল হয়ে পড়ে এবং ফলস্বরূপ দাঁতের মধ্যে স্থায়ীভাবে গর্ত হয়ে যায়। একে সারিয়ে তোলার জন্য এবং আর যাতে গর্ত না হয় তার জন্য ডেন্টিস্টরা দাঁতের মধ্যে ফিলিং করে দেন। দাঁত কে ঠিক রাখতে এবং গর্ত যাতে না হয় তার জন্য এই প্রক্রিয়াটি বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ভেষজ পাউডার ব্যবহার করে দাঁতের গর্ত কী দূর করা সম্ভব?
না, এরকম হয় না। মুখের ভেতরের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রাকৃতিক প্রতিকারের জনপ্রিয়তা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ অনেক মানুষ প্রচলিত দাঁতের চিকিতসার বিকল্প খুঁজছেন। এমন একটি উপায় যা ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়েছে তা হল ডিমের খোসা, বেকিং সোডা এবং নারকেল তেলের মিশ্রণ, যার ব্যবহারে দাঁতের গর্ত ভরাট হয়ে যায় বলে দাবি করা হয়।
তবে, দাঁতের গর্তের চিকিৎসার জন্য ভেষজ পাউডার ব্যবহারের কার্যকারিতার স্বপক্ষে পর্যাপ্ত কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
ডিমের খোলা বা এগশেল পাউডার (ইএসপি) একটি প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসাবে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে যা দাঁতের গর্তের চিকিৎসায় উপকারী বলে বিশ্বাস করা হয়। এটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম ফসফেট, জৈব পদার্থ এবং ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট রয়েছে, কিন্তু স্ট্রন্টিয়াম, ফ্লোরাইড, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক এবং কপার আয়ন কম থাকে। ইএসপি হাড় এবং দাঁতের মেটাবলিজমের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং উঁচু-মানের হাইড্রোক্সাপাটাইট গঠন করতে পারে বলে দেখা গেছে। তবে, এটা মনে রাখা দরকার যে ইএসপি শুধু এনামেল গর্তকে আটকাতে পারে। ল্যাবরেটরি টেস্টে ইএসপি তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে, যদিও বাস্তব জগতে এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এছাড়াও, দাঁতের ভেতরের স্তরে এই গর্ত গভীর হলে এই উপায় কোন কাজ করে না। এরকম ক্ষেত্রে, আরো বেশি ক্ষত হওয়া থেকে দূরে থাকতে হলে পেশাদারী দাঁতের চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া জরুরী।
নারকোল তেল মুখের স্বাস্থ্যবিধি ও দাঁতের গর্ত প্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত নয়। যদিও এধরনের গর্তগুলিকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলার সমাধান না হলেও, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে মুখে অয়েল-পুলিং বা নারকেল তেল সুইশিং করানো ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং প্লাক জমা কম করে মৌখিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারে। নারকোল তেলের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য মুখে ব্যাকটেরিয়া কমিয়ে দিতে সাহায্য করে এবং ক্রমাগত ব্যবহারে নতুন করে ক্যাভিটি তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা রোধ করে। বেকিং সোডা সাধারণত দাঁতের দাগ দূর করতে এবং নতুন করে দাগ ধরতে ও প্লাক জমা রোধ করতে ঘরোয়া উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ক্ষারীয় বা অ্যালকালাইন বৈশিষ্ট্য মুখে অ্যাসিডের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে, যা হয়ত ক্যাভিটি তৈরী হওয়াও রোধ করতে সাহায্য করে। তবে, এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এটির ঘষে ফেলা প্রকৃতির কারণে, বেকিং সোডার অত্যধিক বা অনুপযুক্ত ব্যবহার দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। আপনার মুখের ভেতরের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে নিয়মিত বেকিং সোডার ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডেন্টিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এটি লক্ষণীয় যে দাঁতের গর্তের প্রতিকারের জন্য প্রাকৃতিক উপায়গুলি জনপ্রিয়, তবে তাদের কার্যকারিতার স্বপক্ষে বিশেষ কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। দাঁতের গর্তের প্রতিরোধে এবং মুখের ভেতরের স্বাস্থ্য ভালো রাখার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হল দাঁতের যত্ন এবং পেশাদার নির্দেশিকা মেনে চলা। আমরা যখন ডেন্টাল সার্জেন ও সার্টিফায়েড ইমপ্লান্টোলজিষ্ট, ডাঃ গগনদীপ সোধি (বিডিএস) কে ঘরোয়া উপায়ে তৈরী মিশ্রণ ডিমের খোলার পাউডার, বেকিং সোডা ও নারকোল তেল দাঁতের গর্ত সারিয়ে তুলতে পারে কিনা তা নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম তখন তিনি বলেন যে, এই ভেষজ মিশ্রণটি ডেন্টাল কেরিসের জন্য কোন স্বীকৃত বা বৈধ চিকিৎসা নয়। দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া সাধারণত যাকে বলা হয় দাঁতের গর্ত বা দাঁতের পোকা, এমনই একটি অবস্থা যা সারাতে পেশাদারী দাঁতের বিশেষজ্ঞর সাহায্য প্রয়োজন হয়, এতে ফিলিং বা অন্য কোন চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয় যাতে সঠিকভাবে দাঁতের গঠনকে পুনরায় ঠিক করা যায়। সঠিক ভাবে দাঁতের যত্ন ও দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে অবশ্যই একজন ডেন্টিস্টের সাহায্য নেওয়া জরুরী।
কীভাবে দাঁতে গর্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়?
দাঁতের গর্ত হওয়া রোধ করতে হলে ফ্লোরাইড টুথপেস্ট ব্যবহার করা এবং প্রতিদিন ফ্লসিং করে খুব ভালোভাবে মুখের ভেতরের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, সেইসঙ্গে সঠিক খাবার খাওয়া যেখানে শর্করা বা চিনি কম থাকে এবং অ্যাসিডিক খাবারের পরিমাণ কম থাকে তার দিকে নজর দেওয়া জরুরী। নিয়মিত ডেন্টাল চেক-আপও দাঁতের গর্তের প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং পেশাদার পরিষ্কার পদ্ধতি পালনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গর্ত আটকাতে দাঁতের চেবানোর জায়গাগুলিতে ডেন্টাল সিল্যান্ট ব্যবহার করা যেতে পারে, আবার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল মাউথওয়াশ ব্যবহার করে গর্ত বেড়ে ওঠাকে রোধ করা যেতে পারে। যদি ক্যাভিটি সনাক্ত করা যায় তবে পেশাদারী দাঁতের বিশেষজ্ঞরা এর চিকিৎসার জন্য ফিলিং বা ক্রাউনের সাহায্য নিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চলা যেমন, তামাক বর্জন বা ব্রুক্সিজমের জন্য নাইটগার্ড ব্যবহার করা ক্যাভিটি ম্যনেজমেন্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। বাড়িতে সঠিক যত্নের সঙ্গে নিয়মিত দাঁতের চেকআপ-এর সাহায্যে আপনি দীর্ঘকাল ধরে মুখের ভেতরের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারবেন এবং অনেক গুরুতর সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবেন।