Last Updated on March 12, 2024 by Urmimala Sengupta
সারমর্ম
একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোষ্টে দাবী করা হয়েছে যে পেঁয়াজ ও টুথপেষ্ট দিয়ে ঘষলে ট্যান দূর হয়। এতে সোডা ও গোলাপ জল মেশানোর কথাও বলা হয়েছে। আমরা এর ফ্যাক্ট চেক করে দেখে জেনেছি এই দাবী ভুল।
দাবি
অনেক সোশ্যাল মিডিয়া পোষ্টে পেঁয়াজ এবং টুথপেস্ট ঘষে ত্বকের ট্যানিং দূর করার কথা বলা হয় । তেমনি একটি পোস্ট এইখানে দেখতে পাওয়া যাবে।
সত্যানুন্ধান
মানুষের ত্বকের রঙ কোন কোন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে?
মানুষের ত্বকের অনেক রকম টোন ও রঙ হয়। ত্বকের রঙের পেছনে অনেকগুলি কারণ থাকে, জেনেটিক্স হল প্রধান কারণ। টাইরোসিনেজ এনজাইম জিনগত প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী যা মানুষের ত্বকের রঙ নিয়ন্ত্রণ করে।
মেলানিন হল ত্বকের রঙের প্রধান নির্ধারক, মেলানোসাইট নামক কোষের মাধ্যমে আমাদের ত্বক যাকে তৈরি করে। মেলানিন সেই সমস্ত জিনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে যা পরিমাণগত ও গুণগত দিক থেকে আমাদের ত্বকের রঙ নির্ধারণ করে। এই জেনেটিক প্রক্রিয়া বা মেকানিজম ফ্যাকাল্টেটিভ মেলানোজেনেসিস এবং ট্যানিং প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঠিক হয়। এছাড়াও, ভিটামিন ডি, মেলানিনের মতো, বিভিন্ন টিস্যুতে কোষের বেড়ে চলা এবং পার্থক্য নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এটিও ত্বকের রং প্রভাবিত করতে পারে।
ট্যানিং কী?
ট্যানিং হল এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি(ইউভি)র বিকিরণে ত্বকের রঙ গাঢ় হয়ে যায়। আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনী বিকিরণের প্রাথমিক উৎস হল সূর্যের আলো, কিন্তু ট্যানিং বেডের মতো কৃত্রিম উৎস থেকেও এই রশ্মি বের হয়। যখন ত্বক ইউভি বিকিরণের সংস্পর্ষে আসে তখন শরীরের মেলানোসাইট (যে কোষ মেলানিন তৈরী করে) মেলানিন বেশি মাত্রায় তৈরী করে। ইউভি রশ্মির ক্ষতি যাতে আর না হতে পারে তার জন্য এই কোষগুলির এটি একটি রক্ষণাত্মক প্রতিক্রিয়া বলে মনে করা হয়। মেলানিন হল এমন একটি পিগমেন্ট যা থেকে মানুষের দেহের ত্বক, চুল ও চোখের রঙ তৈরী হয়। এটি ইউভি বিকিরণের শোষণ ও ছেড়ে দেওয়া বা বিচ্ছুরণের সময় প্রাকৃতিক সানস্ক্রীন হিসেবে কাজ করে। মেলানিন ত্বকের গভীর স্তরে প্রবেশের পরিমাণ কমায়। বাড়তি মেলানিন তৈরীর কারণে ত্বক কালো হয় বা ট্যানিং বাড়ে।
ট্যানিং কীভাবে দূর করা যায়?
কিছু পদ্ধতি আছে যা ট্যানিং দূর করতে সাহায্য করেঃ
১। এক্সফলিয়েশন বা ত্বকের ওপরের অংশ তুলে ফেলা – নিয়মিত ভাবে ত্বকের ওপরের অংশ তুলে ফেলার কাজ করলে ত্বকের মৃত কোষ দূর হয়, এর মাধ্যমে ট্যান হালকা হয়। স্ক্রাব, লুফা বা এক্সফলিয়েটিং গ্লাভস দিয়ে ত্বকের সবচেয়ে ওপরের অংশ তুলে ফেললে ট্যান হালকা হয়।
২। ত্বকের-রঙ হালকা করার পণ্য – বিভিন্ন ক্রিম, লোশন এবং সিরাম যাতে এমন উপাদান থাকে যা সময়ের সাথে সাথে ট্যানিংয়ের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করতে পারে। এই পণ্যগুলি ত্বকের প্রাকৃতিক এক্সফোলিয়েশন প্রক্রিয়ার গতিকে দ্রুত করতে এবং মেলানিন তৈরীকে বাধা দিতে সাহায্য করতে পারে।
৩। ব্লিচিং-এর জিনিসপত্র – কেউ কেউ ব্লিচিং-এর সামগ্রী ব্যবহার করতে পারেন, যা ত্বককে হালকা করতে সাহায্য করতে পারে। তবে এর জন্য বিশেষ সতর্কতা জরুরি এবং পেশাদারদের সাহায্য নিয়ে তা করা উচিত। সঠিকভাবে ব্যবহার না করা হলে এগুলি থেকে ত্বকে জ্বালা এবং অন্যান্য সাইড এফেক্ট হতে পারে।
৪। কেমিক্যাল পিল – ডার্মাটোলজিষ্টরা অনেকসময় কেমিক্যাল পিলের সাহায্য নিয়ে থাকেন। এই পদ্ধতিতে একটি রাসায়নিক মিশ্রণ ত্বকে ব্যবহার করা হয় যাতে বাইরের স্তরটি এক্সফোলিয়েট হয় এবং এটি খোসা ছাড়ানোর মত করে উঠে আসে। এটি ট্যানিং এর পরিমাণ কমাতে ও নতুন এবং ফর্সা রঙ-এর ত্বক তৈরীতে কাজে লাগতে পারে।
লেসার চিকিৎসা – ট্যানিং এর জন্য যে হাইপারপিগমেন্টেশন হয় সেই জায়গাগুলিতে কয়েকরকমের লেসার চিকিৎসা বা ইনটেনস পালসড লাইট (আইপিএল) চিকিৎসা করা হয়। এই পদ্ধতিগুলিতে ত্বকের মেলানিন পিগমেন্টগুলি ভেঙে যায়, ফলে ট্যান হালকা হয়ে যায়।
পেঁয়াজ আর টুথপেষ্টের মিশ্রণ লাগালে কী ত্বকের ট্যান দূর করা যায়?
না।পেঁয়াজ আর টুথপেষ্টের মিশ্রণ লাগালে ত্বকের ট্যান দূর হয়, এরকম কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। দাঁতের যত্নের জন্যই টুথপেষ্ট তৈরী করা হয় এবং এটি কখনোই ত্বকে লাগানো উচিত নয়। টুথপেষ্টে এমন কিছু উপাদান থাকতে পারে যা থেকে ত্বকে জ্বালা-যন্ত্রণা বা অ্যালার্জি হতে পারে। অন্যদিকে পেঁয়াজে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, সেটা থেকে হয়তো ত্বকের ক্ষেত্রে কিছু উপকারিতা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু পেঁয়াজ ব্যবহার করে ত্বক সাদা করা যায় কিনা তা এখনো জানা যায়নি।
সাধারণভাবে, ট্যান দূর হলে ত্বক ঝকঝকে হতে পারে কিন্তু ট্যানিং দূর করা এবং ত্বক সাদা করার পেছনের উদ্দেশ্য আলাদা হতে পারে। এক্সফোলিয়েশনের মতো পদ্ধতি, ত্বক-সাদা করার উপাদানের ব্যবহার, বা কেমিক্যাল পিল বা লেজার থেরাপির মতো কিছু চিকিৎসায় ত্বক বা স্কিন টোন হালকা হতে পারে। পিগমেনটেশন কমানো ও ত্বকের রঙ হালকা করতে এই পদ্ধতিগুলির ব্যবহারে ওভারল্যাপিং এফেক্ট থাকতে পারে। লোকমুখে কিছু ঘরোয়া উপায় ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে, কিন্তু পেঁয়াজ বা টুথপেষ্ট কতটা ভালো ভাবে ট্যান দূর করতে পারে তা নিয়ে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।
ডাঃ জয়িতা চৌধুরী, এমডি (ডার্মাটোলজি) বলেছেন, “টুথপেস্টে নন-আয়নিক ডিটারজেন্ট এসএলএস/পলিথিলিন গ্লাইকল, ট্রাইক্লোসান/কোপোলাইমার থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এই জিনিসগুলোর ব্যবহার বিশেষত মুখের ত্বকে, কখনোই করা উচিত নয়। “এমনকি পেঁয়াজ ও টুথপেষ্ট দুটো থেকেই ত্বকে জ্বালা-যন্ত্রণা হতে পারে এবং দুটো একসঙ্গে মিশিয়ে লাগালে তা আরো বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও, পেঁয়াজে সালফার রয়েছে, তার সঙ্গে টুথপেষ্টের উপাদানগুলি মিশ্রিত হলে তা থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়া হতে পারে এবং এর থেকে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে।
ডাঃ ইরাম কাজী, এমডি (ডার্মাটোলজি) বলেন, “টুথপেস্টে এমন উপাদান থাকতে পারে যা দাঁতকে সাদা করতে পারে কিন্তু ত্বককে নয়। টুথপেষ্ট ত্বকে লাগালে তা থেকে ত্বকে জ্বালা-যন্ত্রণা, জ্বালা-পোড়া এবং ত্বক লাল হয়ে যেতে পারে কারণ এর উপাদানগুলি ত্বকের পক্ষে কড়া। ত্বকের কোন সমস্যায় টুথপেষ্ট ব্যবহারের পরামর্শ আমি দেব না।“
এরকমই ত্বকে গোলাপ জলের ভূমিকা নিয়ে আমরা কনসালটেন্ট ডার্মাটোলজিষ্ট ডাঃ সৌম্যা সচদেবার সঙ্গে কথা বলি, তিনি বলেন, “গোলাপ জলে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা ত্বককে কোমলতা দেয় ও ত্বকে লাল হয়ে যাওয়া কমিয়ে দিতে পারে। তাই, অ্যাকনের চিকিৎসায় এর ব্যবহারে উপকার হতে পারে, কিন্তু, সব ধরণের মুখের ত্বকে গোলাপ জলের প্রভাব ভালো হয় না, কারণ এর থেকে ডার্মাটাইটিস বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এছাড়াও, পার্সিয়ানলিলির স্কিন/হেয়ার/অ্যাস্থেটিক্স/আয়ুর্বেদা ক্লিনিকের ডার্মাটোলজিষ্ট এবং মেডিকেল ডিরেক্টর ডাঃ স্বাতী ওয়াতওয়ানি ত্বকে বেকিং সোডা লাগাতে নিষেধ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন বেকিং সোডায় অনেক বেশি মাত্রায় ক্ষারীয় বা অ্যালকালিন পিএইচ রয়েছে, ফলে এতে ত্বকের স্বাভাবিক পরতে ক্ষতি হতে পারে, এতে ত্বকে এনজাইমের কাজ ব্যাহত হতে পারে, যা থেকে বিভিন্ন সমস্যার সূত্রপাত হয়, যেমন জ্বালা-যন্ত্রণা, ত্বকে জলের পরিমাণ কমে যাওয়া, ত্বকের প্রতিবন্ধকতার কাজ ব্যাহত হতে পারে। ত্বকে অ্যাসিডিক পিএইচ রয়েছে এছাড়াও বেকিং সোডার অত্যন্ত ঘর্ষণকারী বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রচুর পরিমাণে অ-নির্দিষ্ট যান্ত্রিক এক্সফোলিয়েশন ত্বককে শুষ্ক করে তুলতে পারে এবং তা থেকে ফুসকুড়ি হয় এবং হাইপারপিগমেন্টেশন বাড়িয়ে ত্বককে আরও সংবেদনশীল করে তোলে।
ডাঃ নেহা খুরানা, এমডি (ডার্মাটোলজি) সহমত জানিয়ে বলেছেন, “ত্বকের চিকিৎসায় নিজে করো গোত্রের কোন পদ্ধতির আমি পরামর্শ দেব না। প্রত্যেককে বুঝতে হবে যে আমাদের ত্বকের পিএইচ অ্যাসিডিক প্রান্তে রয়েছে, এইভাবে একটি মৌলিক পিএইচ যুক্ত কিছু ব্যবহার করা ত্বকের পিএইচ ভারসাম্যকে পরিবর্তন করতে পারে যা ত্বকের আর্দ্রতার বাধাকে প্রভাবিত করে, ফলে ত্বকে জ্বালা, শুষ্কতা এবং এক্সফলিয়েশন হতে পারে। তাছাড়া, টুথপেস্ট থেকে অ্যালার্জিক কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসও হতে পারে।“
সব শেষে, ডাঃ জ্যোতি আগারকর, এমডি (ডার্মাটোলজি) পুরো বিষয়টি সম্পর্কে বলেন, “ভগবান আমাদের খুব সুন্দর একটা দেহ ও ত্বক দিয়েছেন এবং এর রঙ এর পরিবর্তন না করে আমাদের তা নিয়েই আনন্দে থাকা উচিত। আমি সবসময়ই আমার রোগীদের সুষম খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও বেশ কিছুটা পরিমাণে জল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। এর থেকেই যে স্বাভাবিক চকচকে ভাবে ত্বকে আসে তা কোন কৃত্রিম ফর্সা করার পণ্য করতে করতে পারে না। এছাড়াও, যখন আপনি ত্বকের জন্য কোন পণ্য বেছে নেবেন তখন অবশ্যই আপনার ত্বক কোন প্রকৃতির তা দেখে নেবেন। “ত্বক ফর্সা করার অনেকরকম মিথ রয়েছে। থিপ মিডিয়া এর আগে এইসব দাবীর ফ্যাক্ট চেক করে দেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে চিনি আর লেবুর রসের মিশ্রণ দিয়ে ত্বক ফর্সা করা যায় এবং টমেটো ও বেকিং সোডার মিশ্রণ লাগালে ত্বক ফর্সা হয়, ইত্যাদি। ডার্মাটোলিজিষ্টের সুপারিশ করা পণ্যগুলি ব্যবহার করা জরুরি। এছাড়াও, যেকোনো নতুন স্কিনকেয়ার ট্রিটমেন্ট করার আগে সবসময় একজন স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত পেশাদার বা ডার্মাটোলজিষ্টের সাথে পরামর্শ করুন, বিশেষ করে যদি কারোর ত্বক সংবেদনশীল হয় বা কোন সমস্যা থাকে।
Disclaimer: Medical Science is an ever evolving field. We strive to keep this page updated. In case you notice any discrepancy in the content, please inform us at [email protected]. You can futher read our Correction Policy here. Never disregard professional medical advice or delay seeking medical treatment because of something you have read on or accessed through this website or it's social media channels. Read our Full Disclaimer Here for further information.